Sunday, April 17, 2016

বাঙালির অসুখ। জরাগ্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গির বাঙালি পুরুষ


আমি বাঙালির অসুখ নামেএই সিরিজ সাধারণত শুরু করেছিলাম বাঙালির মানসিক বা আচারগত যেসব সমস্যা আমি খুঁজে পেয়েছি তার আঙ্গিকে। অবশ্যই সেটা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির আচরন। আজ বাঙালির মনের ব্যবচ্ছেদ করতে চাই যেখানে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিগত অভিব্যক্তি ও আচরন মূলবিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে নারীর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আলোকপাত করেছি। এটি মূলত সমালোচনা ও নেগেটিভ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। কেউ যদি এই লেখায় আহত হয় আশা করি বুঝতে পেরেছেন আপনাকেই উদ্দেশ্য করেই এটা লেখা হয়েছে। আর আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো বাঞ্চনীয়।

গত কয়েকদিন ধরে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে নানা জলঘোলা হচ্ছে। বরাবরের মতো এবারেও পোষাকের ব্যাপারটি উঠে এসেছে কিছু ছিদ্রান্বেষী মানসিকতার ব্যক্তির কাছ থেকে।কিন্তু এবারের ভিক্টিমের পোষাক ছিল হিজাব ও সহী তবুও তার পোষাক নিয়ে সুবিধা করতে না পেরে এখন তনুর চরিত্র নিয়ে আ্যানালিসিস করছে। আর এটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে পুরুষরা কীভাবে নারীকে দেখে। ধর্ষিত হলেও যেন দোষ তাদেরই ।

বাঙালি পুরুষ মনের ভেতরটা যদি দেখা যায় তাহলে দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডও লজ্জা পাবে। এরা মেয়েদের ভোগ্যপন্য ছাড়া কিছু মনে করে না। মাথায় শুধু অবদামিত কামনার উদ্ধত ছাপ লক্ষ করা যায়। এদের কাছে নারী "মাল"। নিজের মা, বোন ছাড়া সবাই তাদের কামনীয় বস্তু। দাঁড়ান! মা, বোনও বাদ যায় নি! আপনি অনলাইনে মা, বোন  লিখে  সার্চ করলেই বুঝতে পারবেন যে বাঙালি পুরুষ  কাওকে রেহায় দেয় নি। এমন কোন জাতি আছে যেখানে সার্চবারে "ভালবাসা" শব্দটিও একটি ১৮+ শব্দ হয়ে দাঁড়ায়??

এই ছোঁক ছোঁক মানসিকতা আমাদের কত অন্ধকারে ফেলে দিচ্ছে তা অকল্পনীয় ব্যাপার।সব বয়সী নারীরা এমনকি শিশু পর্যন্ত বাঙালি পুরুষের কাছে ভালনারেবল হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন পেপার, টিভি নিউজ আমাদের এই বার্তাই দেয়। কোন নারী ইভটিজিং বা ধর্ষণের শিকার হলে তার পোশাকের দোষ হয়ে যায়, পোষাক ঠিক থাকলে চরিত্রের দোষ হয়ে যায় কিন্তু নিজেরা বহাল তবিয়তে ওই দোষ বারংবার করে। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেটা খুব সহজেই হ্যন্ডল করে নারীদের উপর খড়গহস্ত হয়ে।

বাঙালি সভ্যতার পূর্বালগ্নে এই মনসিকতা ছিল না। সবার স্মরণ করা উচিত ভারতবর্ষ কামশাস্ত্রের দেশ। সেক্স বা কাম পবিত্র বলে গন্য হত। তখন সেক্স শুধু তার প্রয়োজনেই ও ভালোবাসার অনুসঙ্গে  সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরে এটাই বিভিন্ন গুরুজাত নিষিদ্ধের কারণে ট্যাব্যু হয়ে গেল আর শুরু হলো সেক্সুয়াল টিজিং ও ধর্ষণের মতো শব্দের। এখন বিকৃত সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি বাঙালি পুরুষের মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে যার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি।


গত বছরের পহেলা বৈশাখে দলে দলে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা যদি দেখি তাহলে মনে হয় তারা যেন সবসময় শিশ্ন খাড়া করে ঘুরে বেড়ায়। কেউ রেহায় পায়না। মেয়ে দেখলেই মনে মনে তার দৈহিক ব্যবচ্ছেদ করে বাসনা পূরণে লেগে যাই। মা বয়সী থেকে শুরু করে ছোট্ট মেয়ে শিশু পর্যন্ত মাগীতে পরিণত হয়। প্রতিবাদ করলেই খেতাব পাওয়া যায় লুচ্চা, বেশ্যা মাগী হিসেবে!

পুরুষের চরিত্র নিয়ে কথা বললেই নারীর উপর দায় এসে পড়ে। যেন শুধুমাত্র নারীরাই নিজে থেকে এগুলো ডিজার্ভ করে। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর কোন দায় নেই। এই পসঙ্গে একটি লেখা না উল্লেখ করলেই নয়......
২০১৪ সালে ভারতে চলন্ত বাসের মধ্যে মেডিকেল ছাত্রী #দামিনী ধর্ষিত ও পরে তার মৃত্যু হলে গোটা ভারতজুড়ে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। কিন্তু তখনও কিছু ধর্ষকামী মেয়েদের পোষাককে ধর্ষনের কারণ বলেছিলেন নিজেদের ধর্ষকপবৃত্তির কথা উহ্য রেখেই। এর প্রতিবাদে ভারতীয় সাংবাদিক নিবেদিতা এন কুমার ফেসবুকে একটা লেখা লিখেন "Yes, I wear a bra. Yes, it shows. So? " শিরোনামে যেটাতে পুরুষদের মানসিকতার জলন্ত প্রমাণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। আর প্রশ্ন রেখেছেন আমরা পুরুষরা কবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করছি।

মূল লেখাটিঃ
Yes, I wear a bra. Yes, it shows. So?

Why? Why do you do that? Stare at my breasts like they are
cute babies calling out to be cuddled. Strip me naked,
slowly, every time I enter the bus? Try to glimpse into my
cleavage when I am sitting and reading in the metro.
Who gives you the right? To grope me in the crowded bus?
To fall on me "innocently" when I buy popcorn in the theater.
When I sit cross legged in the auto and you stop your bike
and look hungrily at my legs.
A piece of meat, am I?
How do you think I feel? When I have to continuously watch
over my shoulder, because it is 10 pm and there is nobody
at the bus stop, except you. Staring at my neck.
When I panic, because my phone is dead, and I am in a cab
wearing a backless dress?
When my friends and parents worry that I have to travel
alone at night?
When I am sleepless in the bus, thinking, that your hands
will pin me down and yank my clothes away?
What makes you think I should not wear that pretty black
skirt?
To be scared. Afraid. Tensed. Every time I am not at home.
What makes you think I like it when I find you smiling at my
bra strap that shows?
Yes, I wear a bra. Yes, it shows. So?
Ohh, don't say that its my clothes! I have found you eyeing
the waist of that woman who was wearing the plain faded
saree. Your eyes get all excited when the young college
going girl enters the bus in just a kurta, no dupatta covering
her bosom.
And yes, one slip of the pallu or dupatta and you go wild.
Staring. Smiling. And staring.
So, if I have a beer in my hand when I am on a beach, you
think you can click my picture?
When I wear hot pants and laugh with a guy you think you
can pinch my ass?
Does the lit cigarette in my hand seem like an invitation to
you? To come violate my body with your eyes?
Yes, I am a girl and I drink alcohol, so I am an 'easy target'.
Is that it?
Yes, I drink. I smoke. Does that mean I want to have sex
with you and every man on the street?
You. Who teach your daughter to be safe from evil eyes,
don't flinch before mentally having sex with me when you
see me on the street? You, who get angry when a boy
smiles at your sister, don't feel ashamed standing at the
street corner whistling at me every night.
No practice what you preach, for you, right.
Do you still think I am the one who needs to change?

বঙ্গানুবাদঃ ফড়িং ক্যামেলিয়ার অনুবাদে,

 ‘হ্যাঁ,আমি অন্তর্বাস পরি এবং কখনও এটা দেখা যায়, তো?

‘পুরুষরা এমনভাবে আমাদের দেখে, যেন আমরা ধর্ষিত
হওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছি। কোন উসকানি প্রয়োজন
হয় না, কেবল চোখ দিয়েই পুরুষরা আমাদের বিবস্ত্র
করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। আমি মেট্রোতে বসলে
অন্তত একবারের জন্য হলেও অদেখা আমাকে দেখতে
চায় পুরুষরা। কে পুরুষদেরকে এই অধিকার দিয়েছে?
বাসের ভিড়ে ওই পাপী চোখগুলো দিয়ে আমাকে অন্ধের
মত হাতড়ে বেড়াবার? থিয়েটারে পপকর্ন কিনতে গেলে
‘নিষ্পাপীর’ ভান ধরে বদমাশ পুরুষরা আমাকে অনুসরণ
করতে থাকে।
দুই পা ক্রস করে বসলেই তোমাদের ধর্ষকামীতা জেগে
উঠতে হবে কেন? আমি কি কোন মাংস পিন্ড?
পুরুষরা কি মনে করছে? রাতে বাসে চড়লে সবসময়ই তটস্থ
থাকতে হলে, আমাদের কেমন লাগে? কোন না কোন পুরুষ
আমার কাঁধের দিকে, পিঠের দিকে কামাতুর চোখে
তাকিয়েই থাকে। এই রকম নোংরাভাবে নিজের
মনবাসনা প্রকাশ করে তাকিয়ে থাকলে কি অনুভূতি হয়
আমাদের?
আমি আতঙ্কগ্রস্ত হই। কেননা, পোশাক আসলে নারীদের
জন্য সীমান্তের কাঁটাতার। আমাদের শরীর এই সীমান্ত
পেরুলেই আক্রমণ করে বসতে পারে ধর্ষক পুরুষরা।
রাতে আমি একা ভ্রমণে যাব এই ভেবে বাবা-মা
দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লে আমার কেমন লাগে? বাসে
আমাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। আতঙ্ক থাকে, কখন যে
পুরুষদের হাত আমাদের স্বাধীনতা খর্ব করে বসবে তার
কোন নিশ্চয়তা নাই।
কে পুরুষদের বলল যে, আমাদের অন্তর্বাস দেখা গেলে
আর তাতে পুরুষরা কামাতুর দৃষ্টিতে তাকালে আমরা
আনন্দিত হই! হ্যাঁ, আমি অন্তর্বাস পরি এবং কখনও কখনও
এটা দেখা যায়। তো?
পুরুষরা বলার চেষ্টা করে যে, নারীদের পোশাকই
তাদের প্রলুব্ধ হতে আকৃষ্ট করে। অথচ আমি এমন পুরুষ
প্রায়ই দেখি, যারা প্রাণান্তকর চেষ্টা করে শাড়ি
পরিহিত নারীর কোমর দেখার চেষ্টা করছে। পুরুষদের
চোখ আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে, যখন তরুণ কলেজ পড়ুয়া
শিক্ষার্থীরা বাসে উঠে কোন রকম ওড়না ছাড়াই।
এবং হ্যাঁ, ওড়না কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেলেই
পুরুষদের মধ্যে পশু প্রবৃত্তি জেগে উঠবে কেন? অথচ
পুরুষরা তখন এক দৃষ্টিতে দেখে আর হাসতে থাকে।
আমি সমুদ্র তীরে গেলে, আমার হাতে বিয়ার থাকলে
পুরুষরা মনে করে তারা বিনা অনুমতিতে আমার ছবি
তুলতে পারবে! যখন আমি স্বাধীনভাবে পোশাক পরি
এবং কোন পুরুষের সাথে হাসি তখন কেন মন হয়
তোমাদের পুরুষোচিত মানসিকতা চরিতার্থ করার
উপকরণ হবে আমার দেহ?
আমার হাতে সিগারেট জ্বলানো  মানেই কি আমি
পৃথিবীর সমস্ত পুরুষকে ধর্ষণের আমন্ত্রণ জানাই? আমার
দেহকে তোমাদের চোখ দিয়ে ধর্ষণের জন্য মেলে
ধরেছি? একজন নারী ও মদ্যপানকারী বলেই কি আমি
পুরুষদের সহজ শিকারে পরিণত হবো?
হ্যাঁ, আমি ধূমপান-মদ্যপান, সবই করি। তাতে কি আমাকে
রাস্তার সমস্ত পুরুষের সাথে বিছানায় যেতে হবে? তুমি,
তোমার কন্যাকে শিক্ষা দিচ্ছ পুরুষদের পাপী চোখ
থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। কিন্তু রাস্তায় আমাকে
দেখে কেবল দৃষ্টিতেই আমাকে ধর্ষণ করার আগে
একটিবারও তুমি ভেবে দেখ না। তোমরা পুরুষরা,
নিজেদের বোনকে উত্যক্ত করলে ক্ষেপে যাও। কিন্তু
নিজেরা করার সময় দ্বিতীয়বার ভেবে দেখ না।
এখনও কি পুরুষদের মনে হচ্ছে যে তাদের পরিবর্তনের
কোন প্রয়োজন নাই, পরিবর্তন কেবল আমার প্রয়োজন?



প্রশ্নটা কিন্তু বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে কিন্তু বাঙালি পুরুষের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। পৌঁছালেও আবার একই অযুহাত তো আছেই। আবার তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইউনিক ব্যাপার আছে। তারা সবসময় সুন্দরীদের দ্বারা আন্দোলিত হয়। এ পসঙ্গে লেখক ও সমালোচক হুমায়ুন আজাদ বলে গিয়েছেন-
"আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রুপসীর একটু নগ্ন বাহু দেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না।"
তাহলে, আবার ওইখানেই সমস্যা দাঁড়ালো তা হলো মানসিকতা! যা বাঙালি পুরুষ মনকে কুক্ষিগত করে রেখেছে আর উত্তরনের আশাই আমাদের প্রধান লক্ষ। নাহলে, বাঙালি পুরুষ দেহ পাবে কিন্তু মন পাবে না!!

কৃতজ্ঞতাঃ
নিবেদিতা কুমার
ফড়িং ক্যামেলিয়া
ফিনিশিয়া থেকে ফিলিপাইন -আবুল কাশেম
উইকিপিডিয়া

No comments:

Post a Comment